সেলুলয়েডে সাহিত্য ও উত্তমকুমার

সময়টা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রারম্ভ৷ আরতির সঙ্গে প্রবীরের পরিচয় নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবেই ঘটেছিল৷ শহরের বিখ্যাত ধনী শিল্পপতি অমৃত সেনের মেয়ে আরতি৷ অপরূপা, অনন্যা৷ তাকে ঘিরে কলেজের ছেলেদের গুঞ্জন৷ কলেজের মধ্যেই একদিন আরতিকে একলা পেয়ে সুব্রত শ্লীলতাহানি করতে চায় আরতির৷ সুব্রতকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে আরতিকে উদ্ধার করলেন প্রবীর৷ প্রবীরকে বাড়িতে এনে বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন আরতি৷ শিক্ষিত, সুদর্শন প্রবীরকে দেখে মুগ্ধ হলেন মি. সেন৷ এই সময় জাপান নামল যুদ্ধে৷ মি. সেনের যাবতীয় কারবার ছিল জাপানের সঙ্গে৷ সেসব বন্ধ হয়ে গেল৷ মি. সেন সর্বস্বান্ত হলেন৷ বিপদ চারদিক থেকে আসে৷ লন্ডনের বিমান হানায় একমাত্র ছেলে রথীনের মৃত্যুসংবাদ পেলেন মি. সেন৷ শোকে, দুঃখে শয্যাশায়ী হলেন৷ পাশে থেকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রবীর৷ মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল আরতির সঙ্গে প্রবীরের৷ সামরিক বিভাগের ডাকে চলে যেতে হল প্রবীরকে৷ বিদায়ের দিনে আরতি প্রবীরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকব’৷ কলকাতার উপর জাপানি বিমান হানার আতঙ্কে মি. সেন মারা গেলেন৷ এই শহরে কুগ্রহের মতো আবির্ভাব ঘটল অরুণের৷ অরুণ বিয়ে করতে চায় আরতিকে৷ অরুণকে অপমান করে বিদায় করলেন আরতি৷ অপরদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোটর মেকানিক রতনের সঙ্গে পরিচয় হল প্রবীরের৷ দু’জনের চেহারা অবিকল এক৷ দু’জনের ভিতরে গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে৷ মরবার আগে রতনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রবীর; বেঁচে থাকলে তার অন্ধ মা ও স্ত্রীকে প্রবীর দেখবেন৷ কলকাতায় তখন দাঙ্গার তাণ্ডবলীলা৷ যুদ্ধ থেকে ফিরে, রতনের মা ও স্ত্রীর সংবাদ নিতে এসে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেন প্রবীর৷ অন্ধ মা ও স্ত্রী সতীর কঠিন মায়াপাশে বন্দি হলেন প্রবীর৷ ইঞ্জিনিয়র প্রবীর পরিবর্তিত হলেন মোটর মেকানিক রতন ওরফে রত্নেশ্বর ভট্টাচার্যে৷ দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত মানুষদের সেবায় দিবারাত্র পরিশ্রম করেন প্রবীর৷ একদিন হঠাৎ গুণ্ডাদের কবল থেকে আরতিকে উদ্ধার করলেন প্রবীর৷ আরতি চিনতে পেরেছেন, প্রবীর না চেনার ভান করছেন৷ অনেক সন্ধানের পর প্রবীরকে খুঁজে‍ পেলেন আরতি৷ গঙ্গার ঘাটে নিভৃতে বসে নিজের জীবন কাহিনি সব খুলে বলেন প্রবীর আরতির কাছে৷ ভুল ভাঙে আরতির৷ ওই দিকে সতী ইষ্টদেবতা পুরুষোত্তমের বিগ্রহ বুকে করে গঙ্গায় ডুব দেন, আর ওঠেন না৷ এমন এক মর্মস্পর্শী কাহিনির নাম ‘উত্তরায়ণ’৷ কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ পরিচালক অগ্রদূত, প্রবীর ও রতনের দ্বৈত চরিত্রে শিল্পী হলেন মহানায়ক উত্তমকুমার৷ আরতির চরিত্রে সুপ্রিয়া দেব, সতীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়৷ বক্স অফিস জমাতে আর কিছু লাগে কি? না, লাগে না৷ তাই ‘উত্তরায়ণ’ সুপার ডুপার হিট ছবি৷

Bhranti Bilas cinema
বিদ্যাসাগরের কাহিনি আশ্রিত ভ্রান্তিবিলাস ছবি পোস্টারে উত্তমকুমার

বিদ্যাসাগরের একটিমাত্র কাহিনির চিত্ররূপে তিনি হাজির৷ একা তিনি নন, সেখানে তার দ্বৈত-চরিত্র৷ ছবির নাম ‘ভ্রান্তিবিলাস’৷ উত্তমকুমার সেই ছবির প্রযোজক৷ পরিচালক মানু সেন৷ চিরঞ্জীব ও চিরঞ্জিৎ জন্মসূত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এই দুই ভাই ঘটনাচক্রে আবার মুখোমুখি৷ এদের দুই ভৃত্য শক্তিকিঙ্কর ও ভক্তিকিঙ্করও মুখোমুখি৷ ফলে দম ফাটা হাসির ছবি হয়ে উঠল ‘ভ্রান্তিবিলাস’৷

উত্তমকুমার যখন উত্তমকুমার হননি, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে অসিতবরণের ছোটবেলার চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন৷ পরিচালক নীতিন বসু৷ কিন্তু দর্শকের নজর কাড়লেন নরেশ মিত্র পরিচালিত ‘বউঠাকুরানীর হাট’ এবং দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘চিরকুমার সভা’তে৷ দু’টি ভিন্নধর্মী চরিত্র, দুটির ক্ষেত্রেই তিনি সাবলীল৷ বিভূতি লাহা যখন ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ স্ক্রিপ্ট করছেন উত্তমকুমার ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন৷ বিভূতি লাহা জানালেন যে উত্তমকুমারকে দেবার মতো অর্থ প্রযোজকের নেই৷ উত্তমকুমার স্পষ্ট করে জানালেন, ‘টাকা চাই না, রাইচরণ রোলটা চাই’৷ ব্যাস, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ রাইচরণের চরিত্রে অবতীর্ণ হলেন উত্তমকুমার, গ্ল্যামার মুছে ফেলে৷ আর রোমান্টিক ইমেজ ভেঙে প্রভুভক্ত ভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে উত্তমকুমার যে অভিনয় করলেন, তার বোধ হয় কোনও তুলনা নেই৷ 

khokababur return back
রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ছবিতে উত্তমকুমার

শরৎচন্দ্রের মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছদ্মবেশী’র চিত্ররূপে উত্তমকুমার দেখলেন কমিক চরিত্র কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়৷ নকল ড্রাইভার সেজে নিজের স্ত্রীর দিদি জামাইবাবুকে নাজেহাল করার নানান ঘটনায় ভরপুর ছবি ‘ছদ্মবেশী’৷ পরিচালক অগ্রদূত৷ সুধীন দাশগুপ্তের সুরে উত্তমের লিপে মান্না দে’র কয়েকটি গান আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছে৷ দুরন্ত ব্যবসা করল এ ছবি৷ 

chodmobeshi
শরৎচন্দ্রের মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ছদ্মবেশীতে উত্তমকুমার

এবার আসি অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রর কথায়৷ উত্তমকুমার শরৎ কাহিনিতে প্রথম এলেন ‘বড়দিদি’ ছবিতে৷ রিমেক ছবি৷ সব রিমেক সাড়া ফেলতে পারে না৷ ‘ছদ্মবেশী’ যেমন রিমেক হওয়া সত্ত্বেও যখন ছদ্মবেশীকে হার মানি‍য়েছিল তেমনটা ঘটল না ‘বড়দিদি’র ক্ষেত্রে৷ দর্শকদের মনে সুরেন্দ্ররূপী পাহাড়ি সান্যাল ও মাধবীরূপী মলিনা দেবী বেশি দাগ কেটেছিলেন রিমেক ‘বড়দিদি’-তে সুরেন্দ্ররূপী উত্তমকুমার ও মাধবীরূপী সন্ধ্যারাণীর তুলনায়৷ যদিও রিমেকের পরিচালক ছিলেন অজয় কর৷ পাশা উল্টে গেল ‘চন্দ্রনাথ’ ছবির মাধ্যমে৷ চন্দ্রনাথরূপী উত্তমকুমার ও সরযূরূপী সুচিত্রা সেন দর্শকমনে তুমুল আলোড়ন তুললেন৷ পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়৷ বাম্পার হিট ছবি৷ সেই একই ধারাবাহিকতা ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবির বেলাতেও৷

মমতা পিকচার্স -এর ব্যানারে নির্মিত হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত এ ছবির নামভূমিকা দুটিতে অবতীর্ণ হলেন সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার৷ তাঁরা যেন সাহিত্যের পাতা থেকেই উঠে এলেন৷ ছবি দেখার সুখ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এঁরা৷ উত্তমকুমার প্রযোজনা করলেন ‘গৃহদাহ’৷ এটিও রিমেক৷ কিন্তু যেহেতু মহিমের চরিত্রে উত্তমকুমার আর অচলার চরিত্রে সুচিত্রা সেন, তখন দর্শক আনুকুল্য-ধন্য যে হবেই ছবিটি, তা বলা বাহুল্য৷ পরিচালক সুবোধ মিত্র৷ এই জুটিকে আবার পেলাম শ্রীকান্ত উপন্যাসের চতুর্থ পর্ব অবলম্বনে নির্মিত ‘কমললতা’ ছবিতে৷ শ্রীকান্ত যথারীতি উত্তমকুমার, কমললতা চরিত্রে সুচিত্রা সেন৷ গহরের চরিত্রে নির্মলকুমার৷ হরিসাধন দাশগুপ্ত পরিচালিত এ ছবির আবেদন আজও অম্লান৷ যেমনভাবে লোকে মুগ্ধ হয়ে আজও শোনেন রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্রের গাওয়া এ ছবির গানগুলি৷ ‘পথের দাবী’র চিত্ররূপের নামই হল ‘সব্যসাচী’৷ উত্তম শুধু নামভূমিকাতেই নয়, সংগীত পরিচালকও তিনি৷ 

sabyasachi
শরৎচন্দ্রের পথের দাবী অবলম্বনে সব্যসাচী ছবিতে উত্তমকুমার

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের একটি মাত্র কাহিনিতে‍ উত্তমকুমার অবতীর্ণ৷ ছবির নাম ‘ইন্দ্রাণী’৷ পরিচালক নীরেন লাহিড়ী৷ নামভূমিকায় সুচিত্রা সেন৷ এ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার হেমন্ত-গীতা দত্তের গানগুলি আজও জনপ্রিয হয়ে আছে৷ আশাপূর্ণা দেবীর ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকে উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু৷ পরিচালক অগ্রদূত৷ কিরীটির চরিত্রে‍ উত্তমকুমার, তাপসীর ভূমিকায় সুচিত্রা সেন৷ অনুপম ঘটকের সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান৷ সব মিলিয়ে এ ছবি আবেদন সৃষ্টি করল যে দর্শকরা বারবার প্রে‍ক্ষাগৃহমুখী হয়েছেন এ ছবির জন্য৷ মিল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ভূতনাথ এবং ‘স্ত্রী’ ছবিতে মাধব দত্ত উত্তমকুমারের জীবনের দুটি দিকচিহ্ন৷ 

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এক রাশ কাহিনির চিত্ররূপে পাওয়া গেছে উত্তমকুমারকে৷ শুরু ‘জীবন তৃষ্ণা’ দিয়ে৷ তারপর একে একে‍ ‘শঙ্খবেলা’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘সবরমতী’, ‘নবরাগ’, ‘চাঁদের কাছাকাছি’, ‘আরও একজন’৷ আলাদা বলার অপেক্ষা রাখে ‘কাল তুমি আলেয়া’ সম্পর্কে’৷ শচীন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এ ছবির সুরকার উত্তমকুমার৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আশা ভোঁসলেকে দিয়ে তিনি গান গাইয়েছেন৷ ধীরপদের চরিত্রে তাঁর অভিনয় দু’চোখ ভরে দেখার মতো৷ পাশে যোগ্য সঙ্গত করেছেন লাবণ্যরূপী সুপ্রিয়া দেবী এবং সোনা বৌদিরূপী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়৷ ‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে উত্তমকুমার আবার দ্বৈত চরিত্রে৷ ফাটানো অভিনয়৷ মঙ্গল চক্রবর্তী পরিচালক৷ উত্তমকুমারের সঙ্গে কাবেরী বসু ও আরতি ভট্টাচার্যও ছিলেন ওই ছবিতে৷ 

soptopodi cinema
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যাযের সপ্তপদীতে উত্তমকুমার  ও সুচিত্রা সেন

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও একরাশ ছবিতে উত্তমকুমার প্রধান চরিত্রে৷ শুরুটা ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ দিয়ে৷ নির্মল দে পরিচালক৷ বউদি ও দেওর হলেন অনুভা গুপ্তা ও উত্তমকুমার৷ কাবেরী বসু প্রথম যে ছবিতে এলেন তার নাম ‘রাইকমল’৷ নামভূমিকায় তিনি আর অঞ্জনের চরিত্রে উত্তমকুমার৷ পরিচালক সুবোধ মিত্র৷ সারকার পঙ্কজ মল্লিক৷ ‘বিচারক’ ছবিতে বিচারক জ্ঞানেন্দ্রনাথের চরিত্রে উত্তম৷ দ্বিতীয়া স্ত্রী সুরমার চরিত্রে অরুন্ধতী, প্রথম স্ত্রী সুমতির চরিত্রে দিপ্তী রায়৷ পরিচালনা করলেন অরুন্ধতী দেবীর প্রথম স্বামী প্রভাত মুখোপাধ্যায়৷ সার্থক চিত্ররূপ দিলেন তিনি৷ 

শুরুতেই ‘উত্তরায়ণ’-এর কথা উল্লেখ করেছি৷ তারাশঙ্করের ‘বিপাশা’, ‘কান্না’, ‘শুকসারি’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘রাজা সাহেব’-এ ও উত্তমকুমার যথারীতি প্রধান ভূমিকাগুলিতে৷ তবে বাংলা ছবির আরেক মাইলস্টোন ‘সপ্তপদী’, তারাশঙ্করের কাহিনি অবমল্বনেই নির্মিত৷ এ ছবির প্রযোজক উত্তমকুমার৷ কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের শিল্পী তিনি৷ রীনা ব্রাউনের ভূমিকায় সুচিত্রা সেন৷ মূল উপন্যাস থেকে অবশ্য অনেকটাই সরে গিয়েছিল ছবির চিত্রনাট্য৷ তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে হেমন্ত-সন্ধ্যার গাওয়া ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি আজও দর্শক শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে‍৷

বিশিষ্ট বেশ কয়েকজন গল্পকারের একটি করে কাহিনির চিত্ররূপে উত্তমকুমার অবতীর্ণ হযেছেন৷ যেমন, ‘ধনরাজ তামাং’, অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, অনুরূপা দেবীর ‘মন্ত্রশক্তি’, নারায়ণ সান্যালের ‘যদি জানতেম’, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নিশিপদ্ম’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘মোমবাতি’, রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশির পদাবলী’, রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘অমানুষ’, শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’, শৈলেশ দে’র ‘তিন অধ্যায়’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘আনন্দমেলা’৷ 

Cinema shapmochon
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন ছবির পোস্টারে উত্তমকুমার

এর মধ্যে কয়েকটি কথা আলাদা ভাবে বলতেই হয়, যেমন: ‘শাপমোচন’৷ উত্তমের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুরু হচ্ছে এ ছবি থেকেই৷ শুরুতেই ক্লিক করে গেছে৷ ‘নিশিপদ্ম’ ছবিটি গড়ে উঠেছে বিভূতি‍ভূষণের ‘হিংয়ের কচুরি’ গল্প থেকে৷ সে গল্প উত্তমকুমার অভিনীত অনঙ্গ দত্ত চরিত্রটি ছিল না, এটি পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের সংযোজন৷ সেটিও দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে৷ এ ছবিতে উত্তমের লিপে মান্না দে’র গানগুলি সময়কে অতিক্রম করেছে অনায়াসে৷ ‘বনবলাশীর পদাবলী’ শিল্পী সংসদের ছবি৷ চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন উত্তমকুমার, তিনিই নায়ক উদাস চরিত্রের রূপকার৷ শক্তিপদ রাজগুরুর ‘নয়াবসত’ অবলম্বনে শক্তি সামন্ত দ্বিভাষিক ছবি করলেন ‘অমানুষ’৷ সেখানে উত্তমের লিপে কিশোরকুমারের সব সাড়া জাগানো গান৷ বিপরীতে শর্মিলা ঠাকুর৷

Jhinder-Bondi
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝিন্দের বন্দী ছবিতে উত্তমকুমার

সত্যজিৎ রায় যখন ‘চিড়িয়াখানা’ তৈরি করলেন, তখন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট ব্যোমকেশ চরিত্রে ব্যবহার করলেন উত্তমকুমারকে৷ কী অপূর্ব যে মানিয়েছিল শিল্পীকে, তা বলে শেষ করা যায় না৷ তপন সিংহ শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দী’ নির্মাণের সময় উত্তমকুমারকেই বাছলেন দ্বৈত চরিত্রে (গৌরীশঙ্কর এবং শঙ্কর সিং)৷ এ নির্বাচন ছিল সঠিক৷ শরদিন্দুর ‘রাজদ্রোহী’র প্রতাপ চরিত্রেও অসাধারণ ছন্দতার পরিচয় দিলেন উত্তমকুমার৷ সুবোধ ঘোষের চারটি কাহিনির চিত্ররূপে তিনি৷ ছবিগুলি হল—‘ত্রিযামা’, ‘শুন বরনারী’, ‘শিউলিবাড়ি’, ‘জতুগৃহ’৷ শেষোক্তটি উত্তমকুমার প্রযোজিত এবং তপন সিংহ পরিচালিত৷ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘উপহার’ এবং ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবি দুটিতে উত্তমকুমার নায়ক৷ বিশ্বনাথ রায়ের দুটি কাহিনির চিত্ররূপে তিনি নায়ক৷ প্রথমটি ‘জীবন মৃত্যু’, দ্বিতীয়টি ‘কলঙ্কিত নায়ক’৷ দুটিই সুপারহিট ছবি৷ 

Cinema pothe holo deri
প্রতিভা বসুর পথে হল দেরী’তে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন

প্রতিভা বসুর তিনটি কাহিনিতে তিনি নায়ক৷ প্রথমটি হল ‘পথে হল দেরী’, দ্বিতীয়টি ‘আলো আমার আলো’, তৃতীয়টি ‘শ্রীকান্তের উইল’৷ প্রথম দুটির জনপ্রিয়তা বলার অপে‍ক্ষা রাখে না৷ ওই দুটিতে উত্তমের সঙ্গে যে সুচিত্রা সেন৷ তবে এই জুটি নিয়েও প্রবোধকুমার সান্যালের ‘প্রিয় বান্ধবী’ জমেনি৷ এই জুটির এটিই শেষ ছবি৷ প্রফুল্ল রায়ের ‘এখানে পিঞ্জর’ এবং ‘বাঘবন্দী খেলা’ ছবি দুটিতে উত্তমকুমার দেখিয়েছেন কোন উত্তুঙ্গে অভিনয় শিল্পকে নিয়ে যাওয়া যায়৷ বিমল করের ‘হ্রদ’, ‘রৌদ্রছায়া’ ও ‘যদুবংশ’-র চিত্ররূপে উত্তমকুমার নানান ধরনের অভিনয় ধারার প্রদর্শন করলেন৷ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘হারজিৎ’, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘সাথীহারা’ ইত্যাদি উত্তমকুমারের ছবির সংখ্যা বাড়িয়েছে মাত্র৷

agniswar
বনফুল সৃষ্ট অগ্নিশ্বর ছবিতে উত্তমকুমার

ড. নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘মায়ামৃগ’তে তিনি পার্শ্ব চরিত্রে, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র তিনি প্রযোজক৷ ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’র তিনি পরিচালক অভিনেতা, ‘ছিন্নপত্র’তে আবার দ্বৈত চরিত্রে (প্রতীপ ও আশীস), ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ও ‘কাজললতায়’ তাঁর বিপরীতে অপর্ণা সেন৷ ‘বহ্নিশিখা’য় দুর্ধর্ষ এক নেগেটিভ চরিত্রে মহানায়ক উত্তমকুমার৷ বৈপরীত্য তাঁর মজ্জায় মজ্জায়৷ বনফুলের ‘একটি রাত’-এ তিনি সুশোভন, ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে তিনি নামভূমিকায়৷ একটিতে কমেডি চরিত্র, অপরটিতে চূড়ান্ত সিরিয়াস৷ সমরেশ বসুর কাহিনির প্রথম চিত্ররূপে ‘কুহক’ থেকে শুরু করে ‘বিভাস’, ‘অপরিচিত’, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘মৌচাক’ প্রভৃতি কাহিনির চিত্ররূপে সেই উত্তমকুমার৷ উত্তম-অপর্ণা জুটির প্রথম ছবি ‘অপরিচিত’৷ ‘মৌচাক’ ছবির প্রশ্রয়দাতা রসিক দাদা নীতীশের চরিত্রে উত্তমকুমার অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷ 

উত্তমকুমার অভিনীত বহু ছবির প্রিন্ট আজ নষ্ট হয়ে গেছে৷ যেমন অনুরূপা দেবীর ‘মন্ত্রশক্তি’, নিরুপমা দেবীর ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘ব্রতচারিণী’৷ এসব যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত তাহলে আজকের প্রজন্মের দর্শকেরাও বুঝতেন যে কত রকম চরিত্রে অনন্যসাধারণ অভিনয় উপহার দিয়ে গেছেন বাংলা সিনেমার চিরদিনের মহানায়ক উত্তমকুমার৷